যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণা কি মিথ্যা, জানালেন ইরান

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত যুদ্ধবিরতির বার্তার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাময়িক আশাবাদ সৃষ্টি হলেও ইরান তা সরাসরি অস্বীকার করে বলেছে এই ঘোষণা “সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা”। সোমবার (২৩ জুন) ইরানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ট্রাম্প যে চুক্তির কথা বলেছেন, বাস্তবে এমন কোনো সমঝোতা হয়নি।

এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও যুদ্ধবিরতির গুজবের প্রভাবে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার ও আঞ্চলিক অর্থনীতি এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বিশেষত অপরিশোধিত তেলের বাজারে নেমেছে চরম ধস।

সোমবার ট্রাম্প তার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লেখেন, “সবাইকে অভিনন্দন! ইসরাইল ও ইরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। আগামী ৬ ঘণ্টার মধ্যে একটি পূর্ণ এবং সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। চলমান চূড়ান্ত অভিযান শেষ করার পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ বিবেচিত হবে।”

ট্রাম্পের এই ঘোষণাকে অনেকেই কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে এটি ‘আশাবাদী মোড়’ হিসেবে প্রচারিত হতে থাকে।

তবে খুব দ্রুতই তেহরান পক্ষ থেকে আসা প্রতিক্রিয়া এই ঘোষণাকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দাঁড় করায়। তেহরান টাইমস সূত্র জানায়, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে তাদের কাছে যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাব আসেনি, এবং তেহরান এমন কোনো চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেনি।

তেহরানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই ঘোষণাটি ইরানের বিরুদ্ধে একটি কূটনৈতিক জাল বুনে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি হাসিলের একটি প্রচেষ্টা। আমরা যুদ্ধে জড়াইনি, আমাদের ওপর আগ্রাসন চালানো হয়েছে। আত্মরক্ষা আমাদের অধিকার।”

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিরতির গুজব এবং মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক উত্তেজনা প্রশমনের প্রত্যাশায় জ্বালানি বাজারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম একদিনেই আরও ৪% কমে ব্যারেলপ্রতি ৬৮ ডলার-এ নেমে এসেছে। এর আগের ট্রেডিং সেশনে এটি ৭% কমেছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই দর ১২ জুনের চেয়েও কম, যেদিন ইসরাইল প্রথমবার ইরানে সরাসরি হামলা চালিয়েছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা বাস্তবসম্মত না হওয়ায় বাজারে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এখনও দ্বিধান্বিত সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হবে নাকি কোনো কূটনৈতিক সমাধান উদিত হবে।

তেলের দামে পতনের মধ্যেও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী সাড়া লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব বাজার যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে সম্ভাব্য উত্তেজনা প্রশমন হিসেবে দেখছে, যদিও ইরানের প্রত্যাখ্যানের পর সেটি আর স্থায়ী আশা হয়ে উঠছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই ঘোষণা হয়তো তাঁর কূটনৈতিক ইমেজ নির্মাণের প্রচেষ্টা, যার পেছনে বাস্তবসম্মত আলোচনার ভিত্তি নেই। বিশেষত ইরান যেভাবে সরাসরি মিথ্যা আখ্যা দিয়েছে, তাতে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ড. আলী রেজা বলেন, “এটি হয়তো একটি অস্থায়ী মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কৌশল, যেখানে ট্রাম্প স্নায়ুযুদ্ধে নামতে চাচ্ছেন। কিন্তু এর বাস্তব ভিত্তি নেই বলেই এখন প্রমাণিত।”

একদিকে ট্রাম্পের “পূর্ণ যুদ্ধবিরতির” ঘোষণা, অন্যদিকে তেহরানের “সম্পূর্ণ মিথ্যা” দাবির বাস্তবতায় বিশ্ববাসী এখন এক অনিশ্চিত অবস্থায়। তেলের বাজারে দোদুল্যমানতা, কূটনৈতিকভাবে বিভ্রান্তিকর বার্তা এবং শেয়ারবাজারের আপাত উত্তেজনা—সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য আবারও এক জটিল ভূরাজনৈতিক দিকচক্রবালে ঘুরছে। বাস্তবতা হলো, যুদ্ধবিরতি তখনই কার্যকর হবে, যখন তা হবে দুই পক্ষের সম্মতিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছভাবে ঘোষিত। এখন পর্যন্ত, এমন কোনো অবস্থায় পৌঁছানো যায়নি।

সূত্র: তেহরান টাইমস