ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের নতুন মোড়: চীনের  ‘রেয়ার আর্থ’ নিষেধাজ্ঞায় সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশিল্প

২০২৫ এপ্রিল ১৮ ১৫:০৭:৪৪
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের নতুন মোড়: চীনের  ‘রেয়ার আর্থ’ নিষেধাজ্ঞায় সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশিল্প

সত্য নিউজ: চীন-যুক্তরাষ্ট্র চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে নতুন এক সংকট তৈরি হয়েছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ‘রেয়ার আর্থ’ নামে পরিচিত দুর্লভ খনিজ পদার্থের রপ্তানির ওপর চীনের নতুন নিষেধাজ্ঞা মার্কিন অস্ত্র ও বিমান প্রযুক্তি শিল্পে এক গভীর সংকটের জন্ম দিতে পারে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS) জানিয়েছে, চীনের নতুন রপ্তানি লাইসেন্স নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ১২টিরও বেশি প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ খাতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটবে।

এই সতর্কবার্তার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস থেকেও। তাদের মতে, চীন যদি আরও কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তাহলে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পেই আঘাত হানবে না, বরং বাইডেন প্রশাসনের ‘পুনরৌদ্যোগিকরণ’ লক্ষ্যকেও হুমকির মুখে ফেলবে।

“এই পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে চীনকে কৌশলগতভাবে এগিয়ে দেবে এবং প্রযুক্তি ও সামরিক আধিপত্যের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পিছিয়ে ফেলবে,”— মন্তব্য চ্যাথাম হাউসের।

কোন খনিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা?

চীনের নতুন নিষেধাজ্ঞা সাতটি গুরুত্বপূর্ণ রেয়ার আর্থ খনিজকে ঘিরে: স্যামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, টার্বিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, লুটেশিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম। এসব খনিজ অত্যাধুনিক সেনা ও প্রযুক্তি সরঞ্জাম তৈরিতে অপরিহার্য—বিশেষ করে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চুম্বক, সেন্সর, মোটর ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায়।

চীন এ খনিজগুলোর সরাসরি রপ্তানি নিষিদ্ধ না করলেও, কঠোর লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১২ সালে জাপানের সঙ্গেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করে দাম প্রায় দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল বেইজিং।

কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই খনিজগুলো?

রেয়ার আর্থ খনিজ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়, যেমন:

  • F-35 ফাইটার জেট

  • ভার্জিনিয়া ও কলম্বিয়া-শ্রেণির সাবমেরিন

  • টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র

  • প্রিডেটর ড্রোন

  • রাডার সিস্টেম

  • JDAM স্মার্ট বোমা সিরিজ

চীন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৭০% রেয়ার আর্থ খনিজ আহরণ এবং ৯০% প্রক্রিয়াকরণ করে থাকে। পরিবেশদূষণ ও উচ্চ ব্যয়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে চীনের ওপর নির্ভরশীল থেকেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সক্রিয় রেয়ার আর্থ খনি নেই।

আগেই সতর্ক করা হয়েছিল

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। ২০১০ সালে চীন যখন জাপানের সঙ্গে বিরোধে পড়ে তখন প্রথমবারের মতো রেয়ার আর্থ খনিজকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এরপর ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম, গ্রাফাইটসহ কয়েকটি কৌশলগত উপকরণ রপ্তানির ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে।

চ্যাথাম হাউসের গবেষক উইলিয়াম ম্যাথিউস বলেন,

“চীন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ধরে রাখার চেইনেই মূল ইনপুটগুলোয় চেপে বসেছে—সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনকে আধুনিক চিপ ও প্রযুক্তি থেকে বাদ দিতে চায়, তাহলে চীনও সরবরাহ চেইনের গোড়া কেটে দিতে পারে।”

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও সীমাবদ্ধতা

যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প উৎসের খোঁজে ইউক্রেন ও গ্রিনল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছে, তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের ‘গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব’ আন্তর্জাতিকভাবে হাস্যরসের কারণ হয়।

বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক শ্রোডার বলেন, “এটা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জানা ছিল। কিন্তু পশ্চিমারা ভেবেছিল, যতক্ষণ চীন দুষণ সহ্য করে, ততক্ষণ আমাদের দুশ্চিন্তা নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্য আর ভূরাজনীতি যখন সংঘর্ষে জড়ায়, তখন সেই ‘সুবিধাজনক নির্ভরতা’ বিপদ হয়ে দাঁড়ায়।”

চূড়ান্ত পরিণতি: সামরিক আধিপত্যে চীনের সম্ভাব্য এগিয়ে থাকা

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এখন ‘ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান’ তৈরির প্রতিযোগিতায়। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি F-47 নামের যুদ্ধবিমানের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় খনিজের অভাবে তাদের অগ্রগতি থমকে যেতে পারে, আর সেটিই চীনকে একটি কৌশলগত সুবিধা দেবে।

এটা কেবল প্রতিরক্ষা খাতেরই সংকট নয়। টেসলার মতো প্রতিষ্ঠান রেয়ার আর্থের ব্যবহার ২৫% কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অধিকাংশ উচ্চপ্রযুক্তি পণ্যের বিকল্প খুঁজে পাওয়া এখনো কঠিন। রেয়ার আর্থ খনিজ নিয়ে চলমান দ্বন্দ্ব কেবল একটি বাণিজ্যযুদ্ধ নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের সামরিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্য নির্ধারণের লড়াই। এই লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত চীনই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।